একজন ব্যক্তির বিবাহ, তালাক তার ধর্মীয় আইন অনুযায়ী হয়ে থাকে।মুসলিম আইনে বিবাহ হচ্ছে দেওয়ানী চুক্তি,যেখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে দেনমোহর দিয়ে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিবাহ করে।
তালাক শব্দের অর্থ বিবাহ বিচ্ছেদ।অর্থাৎ যার মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী তাদের সম্পর্ক,অধিকার,কর্তব্য থেকে অব্যাহতি পায় তাকে তালাক বলে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে কে কাকে তালাক দিতে পারে। স্বামী-স্ত্রী দুইজনেই তালাক দিতে পারে তবে কিছু শর্ত রয়েছে। যেমনঃ
১.স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাকঃ একজন স্বামী তার স্ত্রীকে যেকোনো সময় তালাক দিতে পারে। তবে শর্ত হচ্ছে দেনমোহরের সকল অর্থ প্রদান সাপেক্ষে কোনো কারণ বা শর্ত ছাড়াই তালাক প্রদান করতে পারে।
২. স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাকঃ মুসলিম আইন অনুযায়ী একজন স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক প্রদান করতে পারে না যদি না স্বামী কর্তৃক বিয়ের সময় স্ত্রীকে তালাকে ক্ষমতা প্রদান করে। মুসলিম সরকারি বিবাহ রেজিস্ট্রি বইয়েযকে কাবিননামা বলে। কাবিননামার ১৮ নং কলামে স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার অধিকার প্রদান করতে পারেন।
এছাড়াও মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন,১৯৩৯ অনুযায়ী কারণ দেখিয়ে স্ত্রী পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে তালাক চাইতে পারে। কারণগুলো হলোঃ
১. চারবছর ধরে স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে।
২. স্বামী দুই বছর ভরণপোষন দিতে অবহেলা করলে (২-ক) স্বামী ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের বিধান লঙ্ঘন করে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করলে।
৩. স্বামী সাত বছর বা ততোধিক সময়ের জন্য কারাদন্ডে দন্ডিত হলে।
৪. স্বামী যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া তিন বছর বৈবাহিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে।
৫. স্বামী পুরুষত্বহীন থাকলে।
৬. স্বামী দুই বছর অপ্রকৃতিস্থ, কুষ্ঠরোগ বা মারাত্মক যৌনব্যাধিতে ভুগলে।
৭. নাবালিকা অবস্থায় স্ত্রীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে থাকলে সাবালিকা (১৮ বছর পূর্ণ) হওয়ার পর স্ত্রী যদি তা অস্বীকার করেন। এতে যৌন সম্পর্ক স্থাপন হলে মোকদ্দমা করা যাবে না।
৮. স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ করলে। যেমন,
ক, অভ্যাসগত স্ত্রীকে মারধর বা আচরনের নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে স্ত্রীর জীবন দুর্বিষহ করে তুললে;
খ. অন্য নারীর সঙ্গে স্বামী মেলামেশা করলে;
গ. নৈতিকতাবিরোধী জীবনযাপনের জন্য স্ত্রীকে বাধ্য করার চেষ্টা করা হলে;
ঘ. স্ত্রীর সম্পত্তি হস্তান্তর করে দিলে বা সম্পত্তিতে বৈধ অধিকার প্রয়োগ থেকে তাঁকে নিবারণ করলে;
ঙ. স্ত্রীর ধর্মীয় চর্চায় বাধা প্রদান করলে;
চ. স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকলে পবিত্র কোরআনের বিধান অনুযায়ী ন্যায়সংগত ব্যবস্থা না নিলে।
৯. মুসলিম আইনে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য বৈধ বলে স্বীকৃত অন্য যেকোন কারণে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের দাবি করতে পারেন। তবে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে এবং বিধানাবলি অনুসরণ না করলে তালাক অকার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তালাক প্রক্রিয়া ঃ
১৯৬১সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭(১)ধারা অনুযায়ী তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর করার জন্য অপরপক্ষকে লিগাল নোটিশ প্রদান করতে হবে।
কাকে/ কোথায় নোটিশ প্রদান করতে হবেঃ অপরপক্ষের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মিউনিসিপ্যালিটির বা সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যানের মেয়রের কাছে নোটিশ লিখিত ভাবে পাঠাবে এবং ওই নোটিশের কপি অতিসত্বর অপরপক্ষের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা নেবে।
আদালতের মাধ্যমে কোনো বিবাহভঙ্গমামলার ডিক্রি হলে সে ডিক্রির কপি চেয়ারম্যানকে প্রদান করলেই ৭ধারার নোটিশ দেওয়ার বিধান প্রতিপালিত হবে।যেপক্ষ থেকে ই তালাকের নোটিশ দেওয়া হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে উভয়পক্ষের মনোনীত প্রতিনিধিনি সালিসি পরিষদ গঠন করবেন।
কীভাবেঃ নোটিশে তালাকে বিষয়ে উল্লেখ থাকবে সাথে তালাক প্রদানকারীর সাক্ষর থাকবে। দুইজন সাক্ষীর সাক্ষর থাকবে। নোটিশ কাজী অথবা একজন আইনজীবীর মাধ্যমে প্রেরণ করা যায়। তবে রেজিস্টার্ড পোস্টের মাধ্যমে দেওয়া উত্তম।
নোটিশ প্রদান না করলে : আইনে নোটিশ প্রদানের কথা বলা হয়েছে। তবে নোটিশ প্রদান না করেও তালাক প্রদান করতে পারবে। কিন্তু নোটিশ প্রদান না করলে সর্বোচ্চ ১ বছরের জেল এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বা উভয়ের বিধান রয়েছে।
নোটিশ প্রত্যাহারঃ যদি নোটিশ দাতা মনে করেন তিনি তালাক চান না তবে আগের নোটিশ পাঠানোর ৩ মাসের মধ্যে আরেকটি নোটিশ পাঠিয়ে আগের নোটিশটি প্রত্যাহার করতে পারেন।
সালিশ পরিষদ গঠনঃ নোটিশ পাওয়ার পর চেয়ারম্যান সালিশ পরিষদ গঠন করবে। সালিশ পরিষদে চেয়ারম্যান, দুই পক্ষের একজন করে দুইজন সদস্য এবং দুই পক্ষের পরিবারের সদস্য ও আত্নীয়-স্বজন অংশগ্রহণ করতে পারবে। সালিশ পরিষদের সাক্ষ্য সহ অন্যান্য বিষয় আলোচনা করে সমস্যাটি সমাধান করার চেষ্টা করা হবে। যদি পরপর ৩ মাসে সমস্যাটি সমাধান না হয় তবে তালাকটি কার্যকর হবে। ধরে নেওয়া হবে যেদিন নোটিশ পাঠানো হয়েছে সেদিন থেকে তালাক কার্যকর হয়েছে।
ইদ্দত ও ভরণপোষণঃ তালাক প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়( ৩ মাস) স্ত্রীর জন্য ইদ্দতের সময়। ওই সময় স্বামী স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। ইদ্দতের সময় যদি প্রতিয়মান হয় যে স্ত্রী গর্ভবতী তবে গর্ভাবস্থা অবসান না হওয়া পর্যন্ত বা বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না।
তালাক সনদ : যে পক্ষ তালাক দিবেন যে পক্ষ তার এলাকার বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রারের কাছে গিয়ে তালাকের বিষয়টি অবহতি করবেন। রেজিস্ট্রার বা কাজী বিষয়টি সত্য বলে উপলব্ধ হলে তালাকটি মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯৭৪ আইনের ৬ নং ধারা অনুযায়ী নিবন্ধন করবেন। তিনি এই নিবন্ধনের একটি সত্যায়িত অনুলিপি প্রদান করবেন।
লেখক পরিচিতি
নাজমুন সাকিব ইতি
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়